মৃতের মায়ের কান্না শুনতে পাচ্ছি এবং শীত আমাকে কাবু করেছে- পার্বণ বার্তা



Image result for লাশ


  পাণ্ডুলিপিঃ  অস্পষ্ট ফিসফাস, গোঙানি আর কান্নার সম্মিলিত অর্কেস্ট্রার মধ্য দিয়ে ভেসে এলো শব্দটা। ঢং। সময়ের হিসেব একটা বেজে দুটোর ঘরে প্রবেশ করেছে। ঘড়ির দিকে তাকালাম। অদ্ভুত সন্নিবেশে বিন্যস্ত ডিজিটাল ঘড়ির অক্ষরগুলো- ০২.০০ ২০.০২.২০২০।
রামানুজান হলে এমন সমন্বয়ের অন্তরালের রহস্য উদঘাটন করতে পারতেন নিশ্চয়। আমি সাধারণ ডাক্তার। সংখ্যাতত্ত্ব নয়, দেহতত্ত্ব নিয়ে আমার কাজ।
স্টেথো গলায় ঝুলিয়ে নিয়ে উঠে পড়লাম। শীত যাই যাই করেও যাচ্ছে না। টেট্রনের জামা গায়ে দিয়ে ভুল করেছি। শীত শীত লাগছে। কিন্তু কিই বা করার আছে? একবার ভাবলাম, ওয়ার্ড বয়কে দিয়ে এক প্যাকেট বেনসন আনতে বলি। কিন্তু না। একটি নরম কোমল মুখ ভেসে উঠলো মনের মাঝে। নিজেকে সংবরণ করলাম।
ডক্টর-রুমের দরজা ঠেলে বেরোতে যাব, 'বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি'র ওয়ার্ড বয়কে দেখতে পেলাম। করিডোরের দুপাশে অগুনতি রোগী বিছানা পেতেছে চিকিৎসার আশায়৷ এই মাঝরাতে বেশিরভাগই নিদ্রা-দেবীর বরে কিংবা সিডেটিভের জোরে ঘুম তলিয়ে আছে। তাদের হাত-পা সারা বারান্দায় এলোমেলোভাবে বিস্তৃত। ওয়ার্ড বয় তার মধ্য দিয়ে হতদন্ত হয়ে ছুটে আসছে। খারাপ কিছু হয়েছে- বোঝা যাচ্ছে।
বার্ন-প্লাস্টিকে রাতের বেলায় ডিউটি ডক্টর থাকে না। চিকিৎসক সংকট। ইমার্জেন্সি কিছু হলে সার্জারি ডিপার্টমেন্টকেই সামলাতে হয়।
'পেশেন্ট এক্সপায়ার করেছে। পার্টি পলিটিক্যাল। দ্রুত চলেন।' কাছে এসেই মুখ খুললো সে।
তিন তলার সিঁড়ির গোঁড়ায় দাঁড়ালাম। আরো তিন তলা উঠতে হবে। বড় করে দম নিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলতে লাগলাম। দুর থেকে হট্টগোল টের পাচ্ছি। আট-দশ জন লোক ফ্লেক্সিবল গেটের পাশের উত্তেজিত ভঙ্গিতে কথা বলছে। ঢুকতেই সবার মনোযোগ আমার দিকে স্থানান্তরিত হলো। রোগীর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।
পালস নেই। বিপি রিডিং নেই। হার্ট সাউন্ড নেই। পিউপিল প্রসারিত। পাণ্ডুর মুখের দিকে চাইলাম। বয়স কত হবে? ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বড়জোর। শিয়রে মধ্যবয়সী এক মহিলা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলেছে। পাশেই দুই-তিন বছরের একটা শিশু আঙুল চুষছে একমনে। হট্টগোলে অথবা ক্ষুধায় তার ঘুম ভেঙে গেছে। তার সম্ভবত ক্ষুধা লাগছে৷ কিন্তু কেউ তার দিকে নজর দিচ্ছে না। মুখে বিরক্তি। সে এখনো বুঝতে পারছে না,তার মা আর কখনো তাকে কোলে নেবে না।

Image result for লাশ


কিছুটা দুরে বছর চল্লিশের রুখো চেহারার এক লোক কারো সাথে কথা বলছে। তার গলায় রাগ। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কয়েকটি কথা কানে এলো। মৃতের স্বামী সে। কণ্ঠে বিষাদ নেই, আছে অভিযোগ।... হাসপাতালে রোগীর চিকিৎসা হয় নি। নার্সরা কথা শোনে না। দিনের মধ্য বড় ডাক্তাররা মাত্র দুই বার আসছে... ইত্যাদি।
ফাইল হাতে নিতে খটকা লাগলো। রোগীর দেহে আগুন লেগেছে নয় দিন আগে৷ হাসপাতেল ভর্তি দেখাচ্ছে তিন দিন। নার্সকে জিজ্ঞাসা করতে বাকি দিনের হদিস মিলল। দুর্ঘটনা ঘটার দিনই ভর্তি ছিল। কিন্তু দুই-তিনদিন চিকিৎসা নেওয়ার পরে, একটু ভালো বোধ করতেই নিজেদের ইচ্ছায় রোগী বাড়ি চলে গেছে। একদিন পর থেকেই যথারীতি প্রস্রাব বন্ধ। বিপদে পড়ে আবার হাসপাতালে আসছে আজকে সকালে। ততক্ষণে সেপ্টিসেমিয়া ডেভেলপ করেছে। সাথে একিউট রেনাল ফেইলার তো আছেই।
আমি সিস্টারকে বললাম, ডেথ সার্টিফিকেট এর কাগজ দিতে। দ্রুত কাজ করতে হবে। নিচ থেকে মাত্র কল দিয়েছে আমাকে। এক্সিডেন্ট করে রোগী দুইটা হাজির। আমি 'ডেথ সার্টিফিকেট' ইস্যু করতে থাকলাম। মৃতের মায়ের কান্না শুনতে পাচ্ছি। তার স্বামী প্রবরের উচ্চকিত কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে মাঝে মাঝে। এই মুহূর্তে একটি শিশুর কান্না সেখানে যুক্ত হয়েছে। মেয়েটি কি বুঝতে পেরেছে, তার মা আর নেই। আমার বেশ শীত লাগছে।


                                                                                          লেখকঃ অমিতাভ অরণ্য 



কোন মন্তব্য নেই

luoman থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.