অবরুদ্ধ দেশে রুদ্ধশ্বাস জীবনঃ সৈয়দ মনোয়ার আলী-পার্বণ ডেস্ক

২২ এপ্রিল আমাদের হিসাব বিভাগে এগারো-বারো জন স্টাফ জয়েন করেছিল। সবাইকে স্যারের কথাগুলো বললাম- যার যার ড্রয়ারগুলো চেক করেন, যারা আসেনি তাদেরগুলোও দেখতে হবে, দরকার হলে তালা ভাঙতে হবে। পোস্টার, লিফলেট, পতাকা, ব্যাজ, ছবি যা আছে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
সবাই দ্রুত হাতে কাজ করে গেল, দেখতে দেখতে মেঝের উপর কাগজের স্তুপ জমে উঠল। এবার আগুন ধরানোর পালা। আকরাম খুব সিগারেট খেতো। পকেট থেকে দেশলাই বের করে আগুন জ্বালাতে যেয়ে সে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো। আমরা কাগজের স্তুপটা ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। নিচের দিকে চােখ পড়তেই থমকে গেলাম। স্তুপের ইপর বঙ্গবন্ধুর প্রমাণ সাইজ ছবি। চোখদুটো জ্বল জ্বল করে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে, আশ্চর্যরকম জীবন্ত, যেন বলছেন- কি রে পোড়াবি নাকি !
আকরাম কয়েক সেকেণ্ড সেদিকে তাকিয়ে থেকে নিঃশব্দে দেশলাইটা পাশে মকসুদ সাহেবের হাতে ধরিয়ে দিল। মকসুদ সাহেব কয়েকজনকে ডিঙিয়ে দেশলাইটা তুলে দিলেন সাব্বিরের হাতে। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, মকসুদ সাহেব ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন। আমরা কেউই বঙ্গবন্ধুর ছবি এবং বাংলাদেশের স্বর্ণালী মানচিত্র খচিত পতাকা পোড়ানোর কথা ভাবতে পারছিলাম না, আবার কেবলমাত্র সাব্বিরের কারণে কোনো বিকল্প খুঁজেও পাচ্ছিলাম না। আমাদের মধ্যে একমাত্র সাব্বিরই ছিল অবাঙালি- আগাখান কমুনিটির সদস্য। ভাবলাম পোড়াতে হলে সাব্বিরই করুক কাজটা। সাব্বির মৃদু হেসে আমার হাতটা টেনে নিয়ে দেশলাইটা ধরিয়ে দিয়ে বলল- ‘মনোয়ার সাব, হাম বাহার সে থোড়া চা পিকে আয়ে।’ ছোটখাটো মানুষটা প্যান্টের দু’পকেটে হাত ঢুকিয়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল। সাথে সাথে কে যেন উচ্চারণ করল-‘গড হেল্প দোজ হু হেল্প দেমসেলভস।’ মুহূর্তে স্তপ হাতড়ে হাতে হাতে বঙ্গবন্ধুর ছবি, বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উঠে গেল স্তুপ থেকে, বিশাল রেকর্ড রূমের পনেরো বছরের পুরানো ফাইল ও রেকর্ডপত্রের আড়ালে অন্তর্হিত হল। তার বদলে বাতিল কিছু কাগজপত্র এনে ফেলা হল স্তুপে। দাউ দাউ করে জ্বলে কাগজের স্তুপটা যখন নিঃশেষিতপ্রায় সাব্বির ফিরে এলো। আমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ক্ষণিক দাঁড়িয়ে অস্ফুট স্বরে বলল- ‘মনোয়ার সাব, নো বডি অব আস কুড অলসো সেট ফায়ার অন দি পোট্রেট আব আওয়ার বিলাভেড্ আগা খান।’ সে তার টেবিলে যেয়ে বসল।
সবাই তখন যে যার টেবিলে বসে মাথা ঝুঁকিয়ে কাজ করছিল। বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে আমি একে একে মুখগুলোর দিকে তাকালাম, সবকটা মুখই মুক্তিযোদ্ধার মুখ, সাব্বিরের মুখও।
কোন মন্তব্য নেই