৭ মার্চের অমর কাব্য
(প্রথমাংশের পর)

আমরা হাঁটতে হাঁটতে হাদিস পার্কে এলাম। পার্কে তখন আওয়ামী লীগের জনসভা চলছিল। সবাই কিছুটা ম্রিয়মান। বক্তারা ইয়াহিয়া খাঁর বিরুদ্ধে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বক্তৃতা করছেন। এক জায়গায় গোল হয়ে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুনলাম। সভা শেষ হওয়ার আগেই মোটামুটি খবর পাওয়া গেল, নরমপন্থী জেনারেল ইয়াকুবের স্থলে জেনারেল টিক্কাকে পূর্ববঙ্গের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এবং তারই নির্দেশে জনসভার রেডিও সম্প্রচার নিষিদ্ধ হয়েছে। টিক্কার সম্পর্কে একটা ভয় আমাদের আগে থেকেই ছিল। বেলুচিস্তানে বিদ্রোহ দমনে তার নৃশংসতা চেঙ্গিজ খাঁ, হালাকু খাঁর সমতুল্য ছিল বলে প্রচার ছিল। মনটা সহসা দমে গেল, ইয়াহিয়া তার সেরা কসাইটাকে এখানে পাঠিয়েছে। তবে সকালে যখন ঘুম ভাঙলো গুমোট ভাব কেটে গেছে, সুবাতাস বইতে শুরু করেছে- শুনলাম রেসকোর্স ময়দানে স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভায় এক দারুণ ভাষণ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু- অতুলনীয় ভাষণ! লোকজন চোখেমুখে প্রত্যয় ও পবিত্র বিশ্বাস নিয়ে ফিরেছে।
কসাই টিক্কা রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার বন্ধ করলে বেতার কর্মীরা সাথে সাথে ধর্মঘট করে বেরিয়ে যায়। টিক্কা তখনো পূর্ববঙ্গের আকাশে, মাটিতে পা রেখেও পারে নি, এই অবস্থায় সে ‘বিয়ের রাতে বিড়াল মারতে’ চেয়েছিলো, উল্টে বাঙালিরাই তাকে মাটিতে নামিয়েছে। সকালে রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর পূর্ণ ভাষণ প্রচারিত হলো। আমরা বাইরে বারান্দায় রেডিও ঘিরে বসে ছিলাম। তার প্রতিটি উচ্চারণ, স্বরগ্রাম আমাদের শিরদাঁড়ায় শিহরণ বইয়ে দিলো। যার কানে সেই অমোঘ বাণী পৌঁছালো সবাই- পাড়া-প্রতিবেশী, পথচারী নিঃশব্দে রেডিওর চারপাশে এসে ভীড় জমালো। বঙ্গবন্ধু চারণকবির মত তার অমর কাব্য পাঠ করলেন...
‘...আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের উপর আমার অনুরোধ রইলো প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ্ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তা-ঘাট যা যা আছে, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।...’
‘...তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা কোরো না। সাতকোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না।...’
‘...প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো-এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’
মহাকাব্য পাঠ শেষ হলো। রেশ থেকে গেলো। সবাই স্তব্ধ। কিছু আগেও ভেবে অস্থির ছিলাম এই বিষম পরিবেশে কি বলবেন বঙ্গবন্ধু। অথচ অসাধারণ প্রজ্ঞায় অবলিলায় এমন কথা বললেন যা সবার প্রাণে ভৈরব রাগের অনুরণন তুললো। নত হওয়া নয়, যুদ্ধ ঘোষণাও নয়, অথচ যুদ্ধ প্রস্তুতির সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা। অন্যদের কথা থাক, বিশেষ কারণে একজনের কথাই বলি- তিনি মেজর জিয়া, তার একমাত্র লেখায় একই অনুভূতি প্রকাশ করেছেন- ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আমাদের কাছে গ্রীন সিগন্যাল বলে মনে হলো, আমরা প্রস্তুতি নিলাম।’
কোন মন্তব্য নেই