পরিবর্তিত বিশ্বে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া!

পার্বণ ডেস্কঃ
করোনার পর পৃথিবীটা বদলে যাবে। সাপ্লাই-চেইনের উপর নির্ভরশীল বর্তমান রাষ্ট্রগুলো আমদানি-রপ্তানির চেয়ে বেশি জোর দেবে স্ব-উৎপাদন-ভোগে, যেন অপর রাষ্ট্রের সাপ্লাইয়ের উপর কম নির্ভরশীল হতে হয়। গ্লোবালাইজেশনে ধাক্কা লাগবে। সাথে সাপ্লাই-নির্ভর অটোমেশনের মাধ্যমে চাকুরিক্ষেত্র কমে যাওয়ার যে আশঙ্কা করা হতো, তার পরিবর্তে নতুন ধরণের চাকুরিক্ষেত্র সৃষ্টি হতে পারে।
তবে অন্তর্বর্তীকালটা খুবই সেন্সেটিভ। কারণ দেশে দেশে অভিবাসীর সংখ্যা অনেক। তাঁদের কেউ ইঞ্জিনিয়ার হন আর কায়িক শ্রমজীবী, অনেকেই চাকুরি টিকিয়ে রাখতে চ্যালেঞ্জের সম্মুক্ষীণ হবেন। কারণ লকডাউন ও ত্রাণ সরবরাহ শুধু সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যে বাস্তব। কোনো দেশেরই অসীম সম্পদ নেই। আজ অ্যামেরিকা নতুন ডলার ছাপিয়ে মুদ্রাস্ফীতি মেনে নিয়ে করোনা মোকাবেলা করছে, কিন্তু কতদিন?
তাই পরিবর্তন আসবে ইমিগ্রেশন পলিসিতে, চাকুরিক্ষেত্রে, অবাধ ভিসায় এবং অবশ্যই স্বাস্থ্য খাতে। মোটাদাগে সব দেশের সিভিল সার্ভিসেই নীতিগত কিছু না কিছু পরিবর্তন আসবে। আমাদের দেশ এই পরিবর্তনের সাথে তাল মেলাতে কতটা প্রস্তুত?
এর উত্তর খুঁজতে হলে জনপ্রশাসনের তাত্ত্বিক পর্যালোচনা করতে হবে। উল্লেখ্য, আজকের আলোচনায় ‘প্রশাসন’ বা ‘আমলা’ বলতে দেশের সকল সরকারি সার্ভিসের ১০ম গ্রেড থেকে উপরের সকলকে বুঝাবে। যেমন দশম গ্রেডের সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার বা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার থেকে শুরু, একদম উপরের শেষ। কারণ উনারা সিদ্ধান্ত গ্রহণে ‘প্রজ্ঞা’ বা ‘ডিস্ক্রিশন’ প্রয়োগ করতে পারেন। এঁদের সংখ্যাটা কয়েক লাখ। সার্ভিসের বাকিরা শুধু আদেশ পালন করেন। রাজনীতিবিদ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা এই আলোচনাভুক্ত নন।
প্রাচীনকালে একই গোত্রে ধনী-দরিদ্র, মহাজন-দেনাদার জাতীয় অনেক উপ-গ্রুপ বিদ্যমান থাকায় তাঁদের মাঝে শাসকের পক্ষে একটি কার্যকর যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরির জন্য জনপ্রশাসনের সৃষ্টি। হাজার হাজার বছর আগে মিশর, রোম প্রভৃতি অঞ্চলে সম্রাটদের পক্ষে দক্ষ কর্মচারীবৃন্দ এই কাজটি করতেন। তাঁরা শাসকদের খুবই বিশ্বস্ত ব্যক্তিবর্গ ছিলেন, ছিলেন কখনো আত্মীয়, কখনো অভিজাত। মেধাভিত্তিক নিয়োগ শুরু হয় চিনে। হান, সুই প্রভৃতি ডাইন্যাস্টিতে।
‘মেধা’ একটি বিমূর্ত ধারণা। এর ডাইমেনশন অসংখ্য। বহু গণিতবিদকে দেখেছি আত্মীয়ের অনুষ্ঠানে মনের ভুলে উপহার না নিয়ে যেতে, রাতের শেষ ফোনটা প্রেমিকাকে না করে আস্তে শুয়েই ঘুমিয়ে যেতে। অর্থাৎ তাঁরা অ্যানালাইটিকাল সমস্যা সমাধানে মেধাবী বলে বিবেচিত হলেও সামাজিক বিবেচনায় মেধাবী নন। তাই ‘মেধাবী’ তকমাটা শুধু অ্যাকাডেমিক রেজাল্টের উপর ভিত্তি করে প্রদান করা সম্ভব নয়, এটা ইস্যুভেদে পরিবর্তিত হয়। এক ক্ষেত্রের মেধাবী আরেক ক্ষেত্রের অতিসাধারণ হতেই পারেন।
পাবলিক ম্যানেজমেন্টে আমলাতন্ত্রের ডেটা অ্যানালাইসিস ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণেই পৃথিবী আজ এতদূর এসেছে। কারণ তাঁকে একই সাথে সোশ্যাল অ্যানালিস্ট, সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ার এবং সামাজিক পরিবর্তনের সূচনাকারী (সোশ্যাল চেঞ্জমেকার) হিসেবে ভূমিকা পালন করতে হয়। তাই আমলা মানেই গবেষক, রিসার্চার। অসংখ্য সিদ্ধান্ত তাঁকে সামাজিক প্রেক্ষাপটে, ধর্মীয় বিবেচনায় নিতে হয়, বর্তমানের ভিত্তিকে ভবিষ্যৎকে নির্দেশ করতে হয়, আর্মিদের মতো ‘ধর তক্তা-মার পেরেক’ প্রক্রিয়ায় আগালে হয় না। আমলাদের নিরপেক্ষ থাকার কোনো সুযোগ নেই। নিরপেক্ষ মানুষ কোনো কাজ ততো দরদ নিয়ে করেন না, যতটা পক্ষপাতদুষ্ট মানুষ করে থাকেন। করোনার দিনগুলো বাইরে তাকান। প্রাইভেট পর্যায়ে বিদ্যানন্দের মতো যেই ছেলেগুলো সবসময় চ্যারিটির কাজ করতো, ওরাই সবার আগে দৌড়ে এসেছে। কারণ ওরা নিরপেক্ষ নয়, মানবতার পক্ষে।
উন্নয়নশীল দেশে আমলারা নিজেদের সামাজিক এলিট হিসেবে দাবি করেন, মেধাবী বলে দাবি করেন। কিন্তু তাঁদের মেধার স্বাক্ষর সীমিত। কারণ মেধার চেয়ে ম্যানেজারিয়াল কাজকর্মে তাঁরা বেশি ব্যস্ত থাকেন। যেমন, ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসে কর্মরত বেশিরভাগ কর্মী মাঠ পর্যায়ে ইঞ্জিনিয়ারিঙের পরিবর্তে বেশিরভাগ সময় ম্যানেজারিয়াল কাজকর্মে ব্যস্ত থাকেন। বাকিদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
মানব সমাজে নেতৃত্ব ৩ প্রকারঃ
১) মোহনীয় (Charismatic)- ধর্মীয় নেতা, বড় মাপের রাজনীতিবিদ। তাঁদের সম্মোহনী ক্ষমতা থাকে।
২) ঐতিহ্যবাহী (Traditional)- পরিবারতন্ত্র, আঞ্চলিকতা প্রভৃতির ভিত্তিতে নির্বাচিত।
৩) আইনগত (Legitimate)- আমলারা এই ক্যাটেগরিতে পড়েন। তাঁরা জনতার নেতা না হলেও সার্ভিসের নেতা বটে। কিন্তু তাঁদের একটি অংশ হতাশ এবং আরেকটি সৃজনশীল। জনাব ডগলাস ম্যাকগ্রেগরের X-Y তত্ত্ব থেকে বিষয়টি জানা যায়। এই হতাশ অংশটাকে উজ্জ্বীবিত করার দায়িত্ব আবার রাজনীতিবিদদের উপর বর্তায়। নইলে তাঁরা রাজনীতিবিদদের উদ্দেশ্য সাধনে পিছপা হতে থাকেন।
জনাব হার্বার্ট সাইমনের ‘স্যাটিস্ফাইং মডেল’ অনুযায়ী, একজন মানুষের পক্ষে কখনোই সম্পূর্ণ যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব নয়। কারণ সাংগঠনিক উদ্দেশ্যের সাথে ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যের স্ববিরোধিতা থাকে। তাই তিনি কর্মীদের ৩ ভাগে বিভক্ত করেছেনঃ
১) ইকনোমিক ম্যান
২) সোশ্যাল ম্যান এবং
ও৩) অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ম্যান
১। ‘ইকনোমিক ম্যান’ সর্বনিম্ন খরচে সর্বোচ্চ মুনাফার চিন্তা করেন। ফলে মানবিক দিকগুলো থেকে তাঁরা দূরে থাকেন। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান সমূহের মাঝে এই আচরণ দেখা যায়। এ কারণেই সরকার থেকে তাঁদের CSR বাধ্যতামূলক করে দেয়া হয়।
২। ‘সোশ্যাল ম্যান’ সকল সিদ্ধান্ত সামাজিক দৃষ্টিকোন থেকে নেন। তিনি সামাজিক ন্যায়নীতি, ধর্ম, মূল্যবোধ প্রভৃতির সীমারেখা দ্বারা নির্ধারিত। ফলে অনেক সময় তাঁরা দ্রুত সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না।
৩। ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ম্যান’ এই দুইয়ের মাঝে যৌক্তিকতার ভিত্তিতে বিকল্প অপশন সমূহ অ্যানালাইসিস করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তবে উনারা অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থ হন। এর পিছে সময়-স্বল্পতা, সীমিত সংখ্যক বিকল্প নিয়ে আলোচনা, মনোযোগ, ভবিষ্যত সম্পর্কে পূর্বানুমানের ব্যর্থতা প্রভৃতি কারণ থাকতে পারে।
আমলাতন্ত্রে যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চেস্টার বার্নার্ডের ভাষায়, ‘আমলার প্রথম কাজ হচ্ছে একটি কার্যকর যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং ফিডব্যাক মেকানিজমের মাধ্যমে তা গতিশীল রাখা।' এই কমিউনিকেশন হলো আমলাতন্ত্রের লাইফব্লাড। এই মাধ্যমে কর্মীদের উপর লিডারশিপ ও মোটিভেশনের সমন্বিত প্রভাব তৈরি হয় যা পরবর্তী সময়ে রাজনীতিবিদদের উদ্দেশ্য সাধিত করে। ভুলে গেলে চলবে না যে, ফেসবুক অত্যন্ত শক্তিশালী একটি যোগাযোগ মাধ্যমে। আমাদের সকলের ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট এখানে সংরক্ষিত। সম্প্রতি কিছু বিষয়ে ব্যক্তিগত মতামত দেয়ার কারণে শিক্ষা ক্যাডারের দুইজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তাই যে যেই সার্ভিসেই থাকুন না কেন, যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করার ব্যাপারে খুবই সতর্ক হতে হবে, সেটা অফিশিয়াল হোক আর আন-অফিশিয়াল।
এখন ব্যাপারটাকে ক্রিটিক্যাল মোমেন্টে উত্তেজিত মস্তিষ্কের সাময়িক বিচ্যুতি ধরে নিয়ে কৌশলগতভাবে সে বরখাস্তের আদেশ পুনর্বিবেচনা করাই হবে প্রকৃত ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ম্যান’-এর কাজ। এই আদেশ পুনর্বিবেচনা না করলে ভবিষ্যতে অন্যান্য সকল সার্ভিসের আমলাদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া রয়ে যেতে পারে, যা পরে নানা ধরণের প্রশাসনিক জটিলতা তৈরি করে রাজনৈতিক সরকারের বৃহত্তর স্বার্থে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারে। এমনিতেই আমাদের দেশের রাজনৈতিক কাঠামো দুর্বল। এর দায় কোনো একক দলের নয় বরং সম্মিলিতভাবে সকলের। যেই দেশের রাজনৈতিক কাঠামোর উপর জনগণের আস্থা যত কম, সেই দেশের রাজনৈতিক কাঠামো তত দুর্বল। আর যেই দেশের রাজনৈতিক কাঠামো যত দুর্বল, তার আমলাতন্ত্র তত শক্তিশালী।
আমাদের দেশে এক শ্রেণির মানুষ কিছু হলেই আর্মির শাসন কামনা করেন। আর্মির কার্যপ্রক্রিয়া সম্পূর্ণ চেইন-অব-কমান্ড দ্বারা নির্ধারিত, কিন্তু আমলাতন্ত্রের পরিচালনায় নিজ নিজ সার্ভিসের সাব-কালচারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই আমাদের মতো প্রিজম্যাটিক সোসাইটিতে আর্মির শাসন জোর করেও বেশিদিন টিকিয়ে রাখা যায় না।
আমলাতন্ত্রের বিবেচনায় সোসাইটি ৩ প্রকারঃ
১) ফিউজড
২) প্রিজম্যাটিক ও
৩) ডিফ্র্যাক্টেড
প্রিজম্যাটিক সোসাইটি বলতে বিক্ষিপ্ত, আনুষ্ঠানিক কিন্তু ওভারল্যাপড সোসাইটিকে বুঝানো হয়। আমাদের গ্রামে একই সাথে ইউনিয়ন পরিষদ, মাতবর বা মাওলানা ধরণের সামাজিক বিক্ষিপ্ত নেতৃত্ব বিদ্যমান। দেশে আধুনিক স্থাপত্যের পাশে রয়েছে কাঁচা ঘর। যুক্তিবাদী মানুষের পাশে রয়েছেন কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ, ভার্সিটির পাশে রয়েছে মক্তব, অ্যালোপ্যাথির পাশে রয়েছে আয়ুর্বেদি। এগুলো সব বিক্ষিপ্ততার উদাহরণ। এ ধরণের সোসাইটিতে আমলাদের মাঝে আত্মকেন্দ্রিকতা ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে অনাগ্রহ দেখা যায়। এই ধরণের সোসাইটিতে আমলাতন্ত্রের সিদ্ধান্তে বন্ধু-পরিবার- সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে পরিচিত- বহু এক্সট্রা ফ্যাক্টর এসে যুক্ত হয়। এ কারণেই এ ধরণের সোসাইটিতে জনতার সাথে সামরিক বাহিনী বেশিদিন কাজ করতে পারে না।
‘ফিউজড সোসাইটিতে’ পরিবার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, গোত্র, বর্ণ, সম্প্রদায় সব শক্তিশালী। সেখানে একই ধরণের জীবন-প্রণালি বিদ্যমান। ফলে সেখানে সামরিক শাসন টিকে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, আফ্রিকার দিকে লক্ষ্য করা যেতে পারে।
আর রাষ্ট্র যখন এগুলোর দায়িত্ব অনেকাংশে নিয়ে নেয়, তখন তা ‘ডিফ্র্যাক্টেড সোসাইটিতে’ পরিণত হয়। উন্নত বিশ্বে এই ধরণের সোসাইটি অহরহ।
প্রিজম্যাটিক সোসাইটিতে গতানুগতিক জনপ্রশাসন যেখানে দক্ষতা, মিতব্যয়িতা ও কার্যকারিতার দিকে নজর দেয়, উন্নয়ন প্রশাসন সেখানে নজর দেয় সামাজিক ন্যায়বিচারের দিকে।
গতানুগতিক প্রশাসন যেখানে প্রতিষ্ঠান-কেন্দ্রিক, উন্নয়ন প্রশাসন সেখানে গ্রাহক-কেন্দ্রিক।
গতানুগতিক প্রশাসন যেখানে মূল্যবোধ-মুক্ত, উন্নয়ন প্রশাসন সেখানে মূল্যবোধ-প্রতিশ্রুত।
গতানুগতিক প্রশাসন যেখানে আত্মমুখী, নিষ্ক্রিয়, হাতিয়াররূপী, উন্নয়ন প্রশাসন সেখানে পরিবর্তনের সূচনাকারী।
এই গতানুগতিক আর উন্নয়ন প্রশাসনে আমলাতন্ত্রের প্রয়োগকে ৩টি তত্ত্ব দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়ঃ
১) ক্ল্যাসিকাল তত্ত্ব
২) নিও-ক্ল্যাসিকাল তত্ত্ব এবং
৩) মডার্ন তত্ত্ব
ক্ল্যাসিকাল তত্ত্ব নিয়মতান্ত্রিকতা, পেশাদারিত্ব, বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা (অধিক উৎপাদন), একটি সংগঠন কেমন হওয়া উচিত, সংগঠনের কী করা উচিৎ-সেসব ধারণা উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। এই তত্ত্বে সংগঠনকে যান্ত্রিকভাবে কল্পনা করা হয়েছে।
নিও-ক্ল্যাসিকাল তত্ত্বে কর্মীদের মানবিক সম্পর্কের উপর বেশি জোর দেয়া হয়েছে। পারস্পরিক সম্মান, আত্মসম্মান, মর্যাদা প্রভৃতি চিন্তাধারা এই তত্ত্বে ফুটে ওঠে। এই তত্ত্বে সংগঠনকে মানবিকভাবে কল্পনা করা হয়েছে।
আর মডার্ন তত্ত্ব এই দুইয়ের সমন্বয়ে গঠিত। এ তত্ত্বানুযায়ী উন্নত দেশ সমূহের আমলাতান্ত্রিক অ্যাপ্রোচে ক্ল্যাসিকাল অফিশিয়াল স্যুট-টাই পরিধান করার পাশাপাশি নিও-ক্ল্যাসিকাল মোটিভেশন প্রয়োগ করে কাজ উদ্ধার করা হয়। নিজে কাজ করার মাঝে কিংবা নিজের কাছে কাজ রেখে দেয়ার মাঝে দক্ষতা কম বরং তা বিভিন্নজনের মাঝে বণ্টনের মাধ্যমে কার্যকরভাবে করিয়ে নেয়াই আসল ম্যানেজারিয়াল দক্ষতা। প্রতিটি সংগঠনই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। ক্ল্যাসিকালে তার সমাধান ছিল আধিপত্যে, ক্ষমতার ভারসাম্যে আর সমন্বয় সাধনে। নিও-ক্ল্যাসিকালে সমাধান ছিল কর্মীদের সম্পর্কোন্নয়ন, কর্মের স্বীকৃতি প্রদান, সিদ্ধান্ত গ্রহণের অংশীদার করে উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে। আর মডার্ন তত্ত্বে সমাধান উভয়ের সমসাময়িক প্রয়োগের মাধ্যমে।
করোনার পর জনতা যা দাবি করেছে, সরকার সাথে সাথে তা প্রয়োগ করছে। স্কুল বন্ধ, ছুটি, লকডাউন, পিপিই, যানচলাচল বন্ধ, ছুটি বাড়ানো-সব আইডিয়া এই ফেসবুকে জনতার মাধ্যমে দাবিকৃত। সরকারও স্বল্পতম সময়ে তা বাস্তবে পরিণত করেছে। এরকম ঘটনা স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছরে একটিবারও ঘটে নাই। অর্থাৎ ফেসবুক এখন দেশের প্রকৃত বিরোধী দল যা সারাক্ষণ সরকারি কর্মকাণ্ডকে মনিটর করছে। করোনার পর এর প্রকাশ পেয়েছে বেশি, কারণ এর জন্যে যথাযথ প্রস্তুতি বিশ্বের কারো ছিল না বললেই চলে।
উন্নত দেশ সমূহের আমলাতন্ত্র তাহলে কিভাবে এগিয়ে আছে?
-ফ্লেক্সিবিলিটির কারণে। উন্নয়ন প্রশাসনের মূল কথাই এটা। যে দেশের আমলারা যত ডায়নামিক, সৃজনশীল, কর্মোদ্যম, সেই দেশের সরকারি সার্ভিস ততো ভালো। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা অনেক দেশে পাবলিক পলিসি প্রণয়নের ক্ষেত্রে ভোটারদের প্রত্যক্ষ অনুমোদন নিতে হয়, সংসদে জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত ন্যায়পাল আমলাতন্ত্রের যে কাউকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। কিন্তু আমাদের দেশের সংবিধানের ৭৭ নং অনুচ্ছেদ এবং ১৯৮০ সালের আইনে ন্যায়পাল নিয়োগের উল্লেখ থাকলেও তা অদ্যাবধি কার্যকর করা হয়নি।
করোনার পর পরিবর্তনশীল বিশ্ব-ব্যবস্থায় আমরা গতানুগতিক ক্ল্যাসিকাল আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে আগামীর সমস্যা সমাধানে নিযুক্ত থাকলে টিকে থাকতে পারবো, নাকি মডার্ন উন্নয়ন প্রশাসনের মতো সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে গ্রাহক-কেন্দ্রিক চেঞ্জ-মেকিংই হবে প্রকৃত সমাধান, তা এখনই চিন্তা করতে হবে। নইলে জনদাবি পূরণের ক্ষেত্রে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব আবারো আগামীতে জনগণের সমালোচনার শিকার হতে পারেন, যা কখনোই কাম্য নয়।
উন্নয়ন প্রশাসনের পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার শুরুটা হতে পারে শিক্ষা সার্ভিসের দুই সরকারি কর্মচারির সাময়িক বরখাস্তের আদেশ পুনর্বিবেচনার মাধ্যমে।
লিখেছেন: Auninda Mahbub
কোন মন্তব্য নেই