রক্তাক্ত জবা-ছাইদুল।
বর্তমান পরিস্থিতি নিয়েই গল্পটি লিখেছি, কাউকে ছোট করার লক্ষ্যে নয়। প্রতিটি চরিত্র কাল্পনিক।
সাহিত্য পার্বণঃ
কি চমৎকার এক ঋতু চলমান! বসন্ত। বাসন্তে সবসময়ই অর্থাৎ প্রতিবছরই সোনার বাংলাদেশ থাকে মুখরিত। অথচ এবার তার উল্টো। সমগ্র বিশ্বে করোনা ভাইরাস ভাইরাল হয়ে গেলো। স্তব্ধ করে দিলো পুরো বিশ্বের মানবসভ্যতাকে। এক মহামারী! কঠিন মহামারী। এই বসন্তে সোনার বাংলায় বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে জাতীয় শিশু দিবস পালিত হয়। এ বার ছিলো বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী। ছিলো উৎসবমুখর বাংলাদেশ। স্তব্ধ হয়ে গেলো। থমকে গেলো স্বাধীনতা দিবস উদযাপন। অথচ সময় বহমান। থমকে নেই ঘড়ির কাঁটা। ঘূর্ণায়মান প্রতিটি গ্রহ- উপগ্রহ আপন গতিতে আপন কক্ষপথে। বসন্তের বাতাস থেমে নেই। ঠিক তেমনই থেমে নেই মানুষের হৃদয়-মন। হাজারো ভয়ের মাঝেও জেগে উঠে প্রেমিকের হৃদয়। নব তারুণ্যে পদার্পণ করার যুবক-যুবতীর থেমে নেই তার আবেগ থেকে। তেমনই থেমে নেই অনুনয়ের প্রেমে পড়া। এটা যে তার প্রথম প্রেমে পড়া তা নয়। এর আগেও সে একজনের প্রেমে পড়েছিলো। পড়েছিলো বললে ভুল হবে। প্রেম হয়েওছিলো। টেকে নি। বর্তমান সুদর্শনা তরুণীটির নাম মেরিন। নামটা যেমন আলাদা, বালিকাটিও তেমন আলাদা। যেমন গুণবতী তেমনই রূপবতী। তার থেকেও সে চমৎকার বুদ্ধিমতি। সুশীল। কম কথা বলে। বুদ্ধিমতী বালিকারা কম কথা বলে। তারা দায়িত্বে অবহেলা করে না। যাহোক, মেরিনের হাসিটা মুক্তোর দানা। সম্ভব হলে অনুনয় সেই সেই মুক্তোর দানাগুলো পরম যত্নে রেখে দিতো নিজের শোবার ঘরে। রাতে আলো নিভিয়ে সে মুক্তোর দানার আলো দেখতো। তার বিশ্বাস আলো পাওয়া যাবে, এমন আলো! কক্ষময় ভালোবাসায় স্নিগ্ধ হয়ে যাবে। নাইট কুইন মেরিনের পছন্দের একটি ফুল। অনুনয় এই ফুলের সন্ধান করে পায়নি। প্রপোজ করবে এই ফুল দিয়ে। অনুনয় এর একটি ছোট নাম দেয়া যেতে পারে। অনুনয় থেকে অনু। করোনাজনিত বর্তমান অবস্থার কারণে অনু গৃহবন্দি আছে। তবে এক ছোট ভাইয়ের দ্বারা শহরের সবগুলো নার্সারিতে সন্ধান করিয়ে ব্যর্থ। নাইট কুইনের গাছ নেই। অবশ্যি মেরিন সন্ধান করতে নিষেধ করেছে। প্রেমে পড়া বলে কথা! টুকটাক চ্যাটিং হয় ম্যাসেঞ্জারে। সুদর্শনা জানে যে, অনু তার প্রেমে পড়েছে। হয়তো বা সুদর্শনাকে নিজের করে পাবে না। অনু প্রতিষ্ঠিত হতে আরও সময় লাগবে। বাংলাদেশে যা প্রেক্ষাপট! অথচ এদিকে মেরিনের বিয়ে দেয়ার জন্য পরিবার মানসিকভাবে প্রস্তুত। যেকোনো সময় সুদর্শন ও উচ্চপদস্থ পাত্রের হাতে সোপর্দ করে দিবে। এতে করে প্রেমিক বালকটি কষ্ট পাবে অথচ কিছু করার থাকবে না। অসীম সাহস নিয়ে এই মুহূর্তে বিয়ে করতে চাইলে হিতে বিপরীত হবে। সে তার মতো ভালোবাসতে থাকুক। এর মধ্যে কোনো উপায় হলে সে দেখা যাবে। এটাই ভালো। শুধু ভালোবাসা দিয়ে তো বেঁচে থাকা যাবে না। হ্যাঁ, এটাই ঠিক।
হঠাৎ মাথাব্যথা আর জ্বর ভর করলো অনুর উপর। সে ছিলো মেসে। করোনা ভয়ে কেউ তার আশেপাশে আসে না। রুমমেট ছোট ভাইটিও অন্যকক্ষে সাময়িক স্থানান্তরিত হলো। হাসপাতালের জরুরি নম্বরে ফোন দিয়ে তাৎক্ষণিক পরামর্শ নেয়। সাধারণ জ্বর-মাথাব্যথার ঔষধ। এই বিষয়টা সুদর্শনা জানে না মনে হয়। ভালো হয় না, সাথে কাশি যুক্ত হয়। অনু মাঝেমধ্যে করোনা সন্দেহ করে আবার চিন্তা বদলায়। করোনা হলে তো ব্যথা হতো, ব্যথা যেহেতু হয়নি তাহলে ভাইরাস নয়। যথেষ্ট পরিমাণ কষ্ট হচ্ছে তার। তবুও মনের কোণে জেগে উঠা প্রেম থেমে থাকে না। অল্প অল্প হাই-হ্যালো হয় ম্যাসেঞ্জারে।

এর মধ্যে তার দেখা হলো পরিচিত এক বড় ভাইয়ের সাথে। বড় ভাইয়ের কিছুদিন আগে এক নার্সের সাথে কাবিন হয়। গত শুক্রবার বিয়ে করে উঠিয়ে নেয়ার কথা ছিলো। সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে স্থগিত হয়ে গেলো। বড় ভাই বাতেন। বাতেন মিয়ার ভয় হলো হবু বউ আবার করোনায় আক্রান্ত না হয়ে যায়। অনু তাকে অভয় দেয়, কোনো লাভ হয় না। সে অবশ্যি ছুটি নিতে বলেছিলো। এই সেকশনে কোনো ছুটি হয় না। হবু বউ তাকে অভয় দেয়। কোনো ঝামেলা হবে না, যদিও ভয় আছে। সে সাবধানে কর্তব্য পালন করছে। প্রোটেকশনের জন্যই ভয়টা বেশি হয়। এটার অভাব রয়েছে এখনও। দিনের পর রাত আসে। রাতের পর হয় সকাল। বাতেনের ভয় বাড়তে থাকে। হবু বউয়ের নাম শাওলা। সে আবেগের মোহে মোহিত নয়। এটা তার পেশা। যথেষ্ট সতর্ক সে।
শাওলার ভীষণ জ্বর। গলা ব্যথা। অসহ্য যন্ত্রণা! তার পাশে পরিবারের কেউ নেই। আইইডিসিআর-এ ভর্তি। কোভিট-১৯ পজিটিভ। এতো সতর্কতার পরও আক্রান্ত হয়ে গেলো। কত স্বপ্নে মোড়ানো ছিলো বন্ধন! বিয়ের পর লম্বা একটা ছুটি নিয়ে পাড়ি দিবে দুজনে দেশ ভ্রমণে। দর্শনীয় স্থানসমূহ ঘুড়ে দেখে ফেলবে। কষ্টসাধ্য তবুও ছুটি মঞ্জুর করাতেই হবে। এসব ভেসে উঠছে শাওলার মনের আয়নায়। মৃত্যু নিশ্চিত ভেবেই নিয়েছে সে। নিয়তি কেন এমন হয়! একটি পবিত্র বন্ধনে কেন প্রাচীর উঠে যায়? কোনো উত্তর নেই তার কাছে। তার মৃত্যুর পর কি বাতেন নতুন করে কারো হাত ধরবে? সে কি কষ্ট পাবে না? সামনে পেলে জিজ্ঞেস করা যেতো। একবার ইচ্ছে হয় তাকে ডেকে পাঠাবে; এটা ঠিক হবে না। সেও আক্রান্ত হয়ে যেতে পারে। সারাজীবন তো একাকী থাকার কথাও না। বাতেন একটু হলেও কষ্ট পাবে- এটা ভেবেই শাওলার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।
চিকিৎসক অজয় কুমার দাস। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। গত সপ্তাহে বিয়ে করেছে ঊর্মিলা দাসকে। ছুটি শেষ করবে দূরের ব্যাপার, বিয়ের পরদিনই হাসপাতালে চলে আসতে হয়েছে। জরুরি তলব। করোনা ভাইরাসের এই মহামারীতে চাপ বেশি। সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর প্রথম সিঁদুরের প্রলেপটাও এখনো জলের স্পর্শ পায়নি। এই অবস্থায় কর্মস্থলে যেতে মনে না চাইলেও যেতে হয়েছে।
লকডাউনের দ্বিতীয় দিবস। ডিউটি ত্যাগ করে বিকাল তিনটায় বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। ক্লান্ত দেহ। কোনোকিছু না পেয়ে অজয় বাবু অনেক কষ্টে একটি ভ্যানে চেপে বসেন। কিছুদূর আসার পর পুলিশের লাঠিচার্জের কবলে পড়ে। বারবার বুঝাতে চেয়েছে যে, সে চিকিৎসক। কোনো কাজ হয়নি। বেত্রাঘাত সহ্য করে বেচারা হেঁটে হেঁটে বাসায় যান। আইডি কার্ড পর্যন্ত দেখানোর সুযোগ দিলো না। অকথ্য গালি তো ছিলোই।
ইতালিতে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন মোর্শেদ সাহেব। নিউজ শুনে একটু খারাপই লাগলো অনুর। বেচারার মৃতদেহটাও আর দেশে আসবে না। ওখানেই কোনোরকম মাটি চাপা দেয়া হবে হয়তো। আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে কেউ মৃতদেহের কাছে যেতে চায় না। হয়তো জানাযাও হবে না। মোর্শেদ লোকটাকে অনু কখনো দেখেনি। শুনেছে। রাজপুত্রের মতো দেখতে। বাবার একমাত্র সন্তান সে। সম্পদের অভাব নেই। বন্ধু রবিনের পাশের বাড়ির মেয়ে অহম। রবিনের থেকেই সে গল্পটা শুনেছে। গল্প নয় এটা, সঠিক ঘটনা। তিন ভাই দুই বোনের ফিতেয় অহম কনিষ্ঠ। উচ্চবিত্ত পরিবার। বাবা ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক। পাশাপাশি ব্যবসা করতেন। এখনও করছেন।
অহম অসম্ভব সুন্দরী। সে সাবলীল ভাষায় চমৎকার ভঙ্গিতে কথা বলতে পারে। উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার সময় সার্বিক কারণে কলেজ ছাত্রীনিবাসে উঠে। অহমের ছোট মামা থাকেন ইতালি। একই কোম্পানিতে তার মামা আর মোর্শেদ কাজ করেন। রাজপুত্রের মতো ছেলে। শিক্ষিতও বটে। আলোচনা করে জামাই হিসেবে পছন্দ হলো। পরিবার ভালো। নিজের তো মেয়ে নেই। ভাগ্নির জন্যেই ভালো। অহমকে নানাভাবে বুঝিয়ে মোর্শেদের সাথে কথা বলায়। ইমু কানেক্ট হয়। ফেসবুক কানেক্ট হয়। ভিডিও কথা হয়। কিছুদিন পর ভালোবাসায় পরিণত হয়। পরিবারের কোনো সদস্য কিছুই জানেন না। তাদের ভার্চুয়াল প্রেম চলে চার বছরের অধিক সময়। অহম সরকারি কলেজে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে। ছাত্রীনিবাসে থাকে। মোর্শেদ দেশে ফিরে আসে। দুজনের সাক্ষাৎ হয় মাঝেমধ্যে। মোর্শেদের মায়ের সাথে অহমের পরিচয় হয়। তাঁরা রাজি আছেন। মেয়ের পরিবার রাজি নয়। প্রবাসী ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিবেন না। শিক্ষক মহোদয় এক কথার মানুষ।
কোর্ট ম্যারেজ করেছে। এছাড়া কোনো উপায় ছিলো না। বিয়ে করে নিজ বাড়িতেই উঠেছে মোর্শেদ। বাবা মা সবাই খুশি। বিষয়টা আশেপাশের কেউ টের পায়নি। তৃতীয়দিন অহম তার বোনকে ফোনে জানায়। ইজ্জতের ব্যাপার। মেয়ে পালিয়ে গেছে শুনলে প্রতিবেশিদের নিকট মাথা নত হয়ে যাবে। পরিকল্পনা করে মেয়েকে নিয়ে আসলেন। মেয়ে দেখার জন্য আসা হবে। মেয়ে পছন্দ হওয়ায় তাৎক্ষণিক বিয়ে হয়ে যাবে। তাই হলো। বউ সাজানো হলো পার্লারে।
নতুন বউ দেখার জন্য প্রতিবেশিরা আসছে। নববধূ খেয়াল করে শুনতে পেলো কেউ কেউ মন্তব্য করছে যে, আগের বউয়ের চেয়ে সুন্দরী আছে। পরদিন সে জানতে পারলো মোর্শেদ আগে বিয়ে করেছিলো। কোনো ঝামেলার কারণে বিচ্ছেদ ঘটেছে। সাধারণ বিচ্ছেদ নয়। বউকে বাপের বাড়ি নিয়ে যাবে বলে বের হয়। বিক্রি করে দেয় পতিতালয়ে। জঘন্য মানুষ না হলে এটা সম্ভব নয়।
সে একজন বিবাহিত এটা কেনো লুকানো হলো, এটা প্রতিবাদ করতে গিয়েই অহম অত্যাচারিত হলো। অকথ্য ভাষায় তাকে গালিগালাজ করলো। প্রতিবাদ করতে গিয়ে আবারও মার খেলো। রিমান্ডের অপরাধীর মতো পিটালো। তৃতীয়দিন অহমের বাবার বাড়ি থেকে কয়েকজন আসলেন। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য অনুযায়ী মেয়েকে জামাইসহ নিয়ে যাওয়া হবে সাথে। মূল বিষয়টা গোপন থেকে গেলো।
শ্বশুরবাড়ি গিয়ে মোর্শেদ থাকলো না। জরুরি অযুহাত দেখিয়ে বিদায় নিলো। অহম বিষয়টা চাপা রাখতে চাইলেও পারলো না। তার বাবা সমাধান করতে চাইলো। সমাধান না করেই মোর্শেদ ইতালি গমন করলো। মামলা করতে চাইলেন, অহম রাজী হলো না। আশায় স্বপ্ন বেঁধে রাখে। হয়তো সে ফিরে আসবে। কিন্তু না, দুই বছর পর ডিভোর্স লেটার এলো।
প্রফেসর ডাক্তার সৃজিত রায় করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। অবস্থা খারাপ হলে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। একমাস পর বড় মেয়ের বিয়ের কথা পাকা হয়ে আছে। সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে বিয়ের নির্ধারিত তারিখ পরিবর্তন করতে হবে। এখন যদি প্রফেসর সাহ্রব মারা যান তাহলে বিয়েতে আর আমোদ থাকবে না। ধূমধাম করে মেয়ের বিয়ে দিবেন, এমন স্বপ্নই ছিলো। বিড়বিড় করে তিনি ভগবানকে ডাকছেন। ডাক্তার নার্সদের সাধারণ মানুষ (সবাই নয়) সবসময় কষাই চামার ইত্যাদি অকথ্য গালি দেয়। অথচ এরাই সবথেকে বেশি সেবা করেন, সাধারণ মানুষ।
কোন মন্তব্য নেই